সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন আজ নেপালের রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সেই আন্দোলনের নেতা সুদান গুরুং জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে তরুণ প্রজন্মের মাঝে আশা জাগিয়েছেন।
নেপালে কয়েক মাস আগে শুরু হওয়া এক ঐতিহাসিক বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন তরুণ নেতা সুদান গুরুং। এবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী মার্চে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। তার এই ঘোষণা নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গুরুং বলেন, জনতার সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তার লড়াই চলবে। তার মতে, দেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। এখন সময় এসেছে তরুণদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার।
যে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়ে সুদান গুরুং জাতীয় পরিচিতি পান, তা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নেপালের তৎকালীন সরকারের পতন ঘটায়। বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় যখন নেপালের সাবেক শাসকগোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—ফেসবুক, এক্স (টুইটার) ও ইউটিউব বন্ধ করে দেয়।
সরকার দাবি করেছিল, এসব প্ল্যাটফর্মকে নেপালে কার্যক্রম চালাতে হলে নিবন্ধন করতে হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো তা না করায় সরকার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সাধারণ মানুষ এটিকে সরকারবিরোধী কণ্ঠরোধের কৌশল বলে মনে করে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বিক্ষোভের আসল কারণ
যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ ছিল বিক্ষোভের ট্রিগার, আসল ক্ষোভ জমে ছিল দেশের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অকার্যকর প্রশাসন নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে নেপালের তরুণ প্রজন্ম মনে করছিল, তাদের সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করা হচ্ছে একদল সুবিধাভোগীর হাতে।
তরুণদের অভিযোগ ছিল—শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য খাত সরকারের অবহেলায় ধ্বংসের মুখে। তার উপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে সরকার স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছিল। এতে করে আন্দোলন দ্রুত বেগ পায়।
প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে বিক্ষোভ শুরু হলেও তা দ্রুত সহিংসতায় রূপ নেয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বহু তরুণ নিহত হন, আহত হন হাজার হাজার। শহরের রাস্তায় টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, টিয়ারশেল আর গ্রেফতারের নাটকীয় দৃশ্য।
সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে নেতৃত্ব দেন সুদান গুরুং। তিনি শুধু আন্দোলনের মুখপাত্রই নন, বরং মাঠের সক্রিয় সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছেন। ফলে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠেন।
গুরুংয়ের রাজনৈতিক যাত্রা
৩৬ বছর বয়সী সুদান গুরুংয়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় না কোনো প্রতিষ্ঠিত দলে, বরং রাস্তায়, বিক্ষোভের মিছিলে। তিনি নেপালের তরুণ প্রজন্মের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন জেন-জি বিক্ষোভ চলাকালে।
গুরুং নিজেই বলেছেন, ‘‘সাবেক সরকারের স্বার্থপরতা ও দুর্নীতি আমাদের রাজনীতিতে টেনে নিয়ে এসেছে। যদি তারা এই ধরনের রাজনীতি চালিয়ে যেতে চান, তবে আমরাও জানিয়ে দিচ্ছি—আমরা পিছু হটব না। আগামী নির্বাচনে আমরা লড়ব।’’
তার দল ইতিমধ্যে দেশজুড়ে আন্দোলন ও প্রচার কার্যক্রম শুরু করেছে। গুরুং জানিয়েছেন, তারা কোনো গতানুগতিক রাজনৈতিক দল তৈরি করতে চান না। বরং তাদের লক্ষ্য একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করা।
বিক্ষোভের সময় সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করলেও তরুণরা বিকল্প ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার শুরু করে। গুরুংয়ের টিম এখনো ডিসকর্ড ও অন্যান্য অ্যাপ ব্যবহার করে নীতি-নির্ধারণী আলোচনা চালাচ্ছে।
তাদের লক্ষ্য হলো, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণদের মতামত সংগ্রহ করে বাস্তবসম্মত নীতি তৈরি করা। স্থানীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবকরা যোগাযোগ কমিটি, আইনি সহায়তা কমিটি এবং সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন।
গুরুং বলেন, ‘‘আমরা চাই প্রতিটি কণ্ঠস্বর গুরুত্ব পাক। তরুণদের শক্তিকে একত্রিত করলে আমরা শুধু আন্দোলন নয়, শাসন ক্ষমতাও নিতে পারব।’’
গুরুংয়ের অবস্থান স্পষ্ট—তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নয়, বরং দলীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচন করবেন। তার যুক্তি, ‘‘আমি যদি একা স্বতন্ত্র প্রার্থী হই, তবে তরুণদের যে শক্তি তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগানো যাবে না। একত্রে আমরা শক্তিশালী, একত্রে আমরা পরিবর্তন আনতে পারব।’’
তার এই ঘোষণা তরুণ ভোটারদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকেই মনে করছেন, নেপালের রাজনীতিতে এটি হতে পারে এক ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট।
নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতায় ভরা। রাজতন্ত্রের পতন থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ, দলীয় কোন্দল—সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ সবসময়ই অনিশ্চয়তায় ছিলেন। বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে যে পরিবর্তনের ডাক উঠেছে, তা দেশটির জন্য নতুন অধ্যায় সূচনা করতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু তরুণদের আবেগ দিয়ে রাজনীতি টিকিয়ে রাখা যাবে না। টেকসই রাজনৈতিক কাঠামো, অর্থনৈতিক সংস্কার ও পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে স্পষ্ট পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে হবে।
গুরুংয়ের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো সংগঠনকে সুসংহত করা। তরুণদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে একজোট হতে পারে। তাছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় আর্থিক সামর্থ্য, প্রচারযন্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবু গুরুং আশাবাদী। তার ভাষায়, ‘‘আমরা আর পেছনে ফিরব না। আমাদের আন্দোলন শুধু প্রতিবাদের নয়, শাসনের জন্যও। আগামী নির্বাচনে আমরা প্রমাণ করব, তরুণরাই পরিবর্তনের শক্তি।’’
এখন প্রশ্ন হলো—এই আন্দোলন কি সত্যিই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতায় রূপান্তরিত হতে পারবে? নাকি এটি ইতিহাসে আরেকটি ক্ষণস্থায়ী তরুণ আন্দোলন হিসেবেই থেকে যাবে? সময়ই তার উত্তর দেবে।