
প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে আলোচিত নামগুলোর মধ্যে একটি হলো স্যামসাং। দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রতিষ্ঠানটি স্মার্টফোন ও ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স বাজারে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বহু বছর ধরে। বিশেষ করে ফোল্ডেবল ফোনে তাদের সাফল্য অন্য যে কোনো ব্র্যান্ডের তুলনায় বেশি। এ কারণে স্যামসাংয়ের প্রতিটি নতুন পণ্যের ঘোষণাই প্রযুক্তিপ্রেমীদের কাছে বাড়তি আগ্রহের জন্ম দেয়। চলতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ট্রাই-ফোল্ড ফোন এবং একটি নতুন এক্সআর হেডসেট উন্মোচনের কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে, ট্রাই-ফোল্ড ফোনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা আপাতত পিছিয়ে যাচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম ইটি নিউজ জানিয়েছে, স্যামসাং আগামী ২১ অক্টোবর ‘প্রজেক্ট মুহান’ কোডনেমের একটি এক্সআর (Extended Reality) হেডসেট বাজারে আনার পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্য দিয়ে স্যামসাং প্রথমবারের মতো মিক্সড রিয়েলিটি জগতে প্রবেশ করছে।
এই হেডসেটটির বিশেষত্ব হলো এতে ব্যবহার করা হয়েছে এআই-ভিত্তিক কন্ট্রোল সিস্টেম, যা ব্যবহারকারীর চোখ ও হাতের নড়াচড়া নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম। ফলে ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের অভিজ্ঞতা আরও বাস্তবসম্মত হবে। একই সঙ্গে এতে অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক নানা অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ থাকবে, যা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী হেডসেটের তুলনায় এটিকে বাড়তি সুবিধা দেবে।
হেডসেটটিতে থাকছে কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন এক্সআর২+ জেন ২ প্রসেসর এবং উচ্চ রেজল্যুশনের ডিসপ্লে। এই হার্ডওয়্যার কনফিগারেশন হেডসেটটিকে মেটার কোয়েস্ট সিরিজ এবং অ্যাপলের বহুল আলোচিত ভিশন প্রো-এর শক্ত প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তুলবে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, স্যামসাং যদি প্রতিযোগিতামূলক দামে ডিভাইসটি বাজারে আনতে পারে, তাহলে মিক্সড রিয়েলিটি সেগমেন্টে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
অন্যদিকে, স্যামসাং ভক্তদের জন্য কিছুটা হতাশার খবরও এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গ্যালাক্সি ট্রাই-ফোল্ড ফোন চলতি মাসেই এক্সআর হেডসেটের সঙ্গে উন্মোচনের কথা থাকলেও এখন তা আর হচ্ছে না। নতুন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ফোনটির মান যাচাই ও চূড়ান্ত পরীক্ষার কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। এজন্য স্যামসাং অন্তত নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত সময় নিতে চায়।
প্রযুক্তি দুনিয়ায় এরই মধ্যে স্যামসাংয়ের গ্যালাক্সি জি ফোল্ড সিরিজ ফোল্ডেবল বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বইয়ের মতো ভাঁজ করা যায় এমন এই ডিভাইসগুলোর নকশা ও স্থায়িত্ব ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে ট্রাই-ফোল্ড ফোনটি আরও জটিল নকশার, যেখানে ডিভাইসটিকে এক নয়, দুই জায়গায় ভাঁজ করা যায়। এর ফলে ব্যবহারকারীরা চাইলে ফোনটিকে ট্যাবলেট আকারে বড় স্ক্রিনে ব্যবহার করতে পারবেন, আবার সহজে ভাঁজ করে ছোট করে বহনও করতে পারবেন।
স্যামসাংয়ের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও ট্রাই-ফোল্ড ফোনের উন্মোচন পিছিয়ে দেওয়া হতে পারে। একই সময়ে দুটি বড় পণ্য বাজারে আনা হলে গণমাধ্যম ও গ্রাহকের মনোযোগ বিভক্ত হয়ে যেত। এখন আলাদা সময়ে বাজারে আনার ফলে প্রতিটি পণ্যই আলাদাভাবে যথেষ্ট প্রচারণা পাবে।
এ ছাড়া ফোল্ডেবল ফোনের মতো জটিল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ একটি বড় বিষয়। স্ক্রিনের স্থায়িত্ব, হিঞ্জ বা ভাঁজ করার মেকানিজম, ব্যাটারির দীর্ঘস্থায়িত্ব—সবকিছু নিশ্চিত করেই বাজারে আনতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এর আগেও ফোল্ডেবল ফোন উন্মোচনের শুরুর দিকে কিছু ত্রুটির কারণে স্যামসাংকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। তাই এবার আরও সতর্ক হচ্ছে তারা।
স্যামসাংয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল ইতিমধ্যেই তাদের ভিশন প্রো হেডসেট বাজারে এনেছে, যা প্রযুক্তি মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। মেটা তাদের কোয়েস্ট সিরিজের মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সেক্টরে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে স্যামসাংয়ের প্রবেশ মিক্সড রিয়েলিটি বাজারকে আরও বৈচিত্র্যময় করবে।
অন্যদিকে, ফোল্ডেবল ফোনের বাজারে হুয়াওয়ে, শাওমি ও অপ্পোর মতো চীনা ব্র্যান্ডগুলোও সক্রিয়। তবে বিক্রির দিক থেকে স্যামসাং এখনো শীর্ষস্থানে রয়েছে। ট্রাই-ফোল্ড ফোন বাজারে আনতে পারলে স্যামসাং আবারও প্রতিযোগীদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মিক্সড রিয়েলিটি ও ফোল্ডেবল ডিভাইস বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারের বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। একদিকে যেখানে এক্সআর হেডসেট নতুন ধরনের বিনোদন, গেমিং এবং কাজের অভিজ্ঞতা তৈরি করবে, অন্যদিকে ট্রাই-ফোল্ড ফোন ব্যবহারকারীর হাতে দেবে আরও বহুমুখী ডিভাইস ব্যবহারের স্বাধীনতা।
স্যামসাং যদি সঠিক সময়ে এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে এই ডিভাইসগুলো বাজারে আনতে পারে, তাহলে তাদের বাজার শেয়ার আরও বাড়বে। বিশেষ করে প্রযুক্তিপ্রেমী ও প্রিমিয়াম ব্যবহারকারীরা এই নতুন ডিভাইসগুলোর দিকে ঝুঁকবে।
যদিও স্যামসাং ভক্তরা ট্রাই-ফোল্ড ফোনের জন্য কিছুটা অপেক্ষায় থাকবেন, তবু আসন্ন এক্সআর হেডসেটের উন্মোচন ইতিমধ্যেই প্রযুক্তি দুনিয়ায় উত্তেজনা তৈরি করেছে। অক্টোবর মাসে হেডসেটটির আত্মপ্রকাশ এবং নভেম্বরের শেষের দিকে ট্রাই-ফোল্ড ফোনের উন্মোচন—দুটিই বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
স্যামসাংয়ের এই নতুন যাত্রা শুধু প্রতিষ্ঠানটির জন্য নয়, বরং পুরো প্রযুক্তি বাজারের জন্যই এক নতুন অধ্যায় সূচনা করতে যাচ্ছে।