যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে এক গির্জায় রবিবার ভয়াবহ বন্দুক হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারী গাড়ি নিয়ে সরাসরি গির্জায় ঢুকে গুলি চালান এবং পরবর্তীতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত চারজন নিহত এবং আটজন আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় পুলিশ। হামলার সময় গির্জায় শত শত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এই ভয়াবহ ঘটনায় দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোক ও আতঙ্কের ছায়া।
ঘটনাটি ঘটে রবিবার সকালে, যখন মিশিগানের স্থানীয় একটি গির্জায় সাপ্তাহিক প্রার্থনা অনুষ্ঠান চলছিল। গির্জার ভেতরে শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ শত শত মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। ঠিক সেই সময় একটি গাড়ি দ্রুতগতিতে গির্জার প্রধান দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গাড়ি থেকে বের হয়েই হামলাকারী এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করেন। আতঙ্কিত মানুষজন প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন নারী বলেন, "আমি শুধু চিৎকার শুনছিলাম। সবাই দৌড়ে পালাচ্ছিল। আমার পাশের একজনকে গুলি করা হয়, তিনি সেখানেই লুটিয়ে পড়েন। এর আগে কখনো এমন ভয়াবহতা দেখিনি।"
গুলি চালানোর পর হামলাকারী গির্জার ভেতরে দাহ্য পদার্থ ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেন। মুহূর্তেই পুরো ভবন ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। আহত অনেকেই আগুন ও ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে যান।
পুলিশ প্রাথমিকভাবে চারজন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। নিহতদের মধ্যে দুজনকে ঘটনাস্থলেই মৃত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে উদ্ধার তৎপরতা চলাকালে আরও দুইজনের মরদেহ উদ্ধার হয়। আহত আটজনকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা।
এখনো কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। আগুন ও ধ্বংসস্তূপের কারণে রাত পর্যন্ত উদ্ধারকাজ অব্যাহত থাকে।
পুলিশ পরে হামলাকারীর পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তার নাম টমাস জ্যাকব স্যানফোর্ড। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন এবং পুলিশের পাল্টা গুলিতে নিহত হন।
টমাসের ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, তিনি স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। হামলার উদ্দেশ্য বা কারণ এখনও পরিষ্কার নয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তার অতীত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যকলাপ এবং সম্ভাব্য মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়গুলো তদন্ত করছেন।
হামলার খবর পাওয়ার পরপরই পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। তারা প্রথমেই মানুষজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে গির্জার ভেতরে আটকে পড়াদের উদ্ধারের জন্য বিশেষ অভিযান চালানো হয়।
মিশিগান পুলিশ কমিশনার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "এটি একটি হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা। নিরপরাধ মানুষদের ওপর এ ধরনের হামলা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আমরা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করছি। হামলাকারীর উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে কিছুটা সময় লাগবে।"
এ ছাড়া, এফবিআইও (FBI) তদন্তে সহযোগিতা করছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা টমাস স্যানফোর্ডের সম্ভাব্য চরমপন্থী সংযোগ, অস্ত্রের উৎস এবং হামলার পেছনের প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখছে।
বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা সত্যিই ভয়াবহ। অনেকেই জানিয়েছেন, এক মুহূর্তে পুরো প্রার্থনার স্থানটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে যায়।
একজন বেঁচে যাওয়া তরুণ বলেন, "আমি আমার ছোট বোনকে নিয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি গাড়ি ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গুলির শব্দ শুরু হয়। আমি তাকে নিয়ে টেনে বের হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহর রহমতে আমরা বেঁচে যাই।"
অন্য একজন বলেন, "এটি যেন দুঃস্বপ্ন ছিল। মানুষজন ধাক্কাধাক্কি করে পালাচ্ছিল, কেউ কাউকে চিনতে পারছিল না। আগুনে পুরো জায়গা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।"
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে বন্দুক সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে স্কুল, গির্জা ও জনসমাগমস্থলে এ ধরনের হামলার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত কয়েকশো "মাস শুটিং" বা গণবন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বহু হামলার পেছনে মানসিক অসুস্থতা, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, বর্ণবিদ্বেষ কিংবা ধর্মীয় বিদ্বেষ কাজ করেছে।
মিশিগানের সাম্প্রতিক এই হামলা আবারও যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে বিতর্ককে সামনে এনেছে। অনেকেই বলছেন, শক্তিশালী বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন ছাড়া এমন হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এক বিবৃতিতে নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, "এই ট্র্যাজেডি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সহিংসতা কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আমরা এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সবকিছু করব।"
এদিকে স্থানীয় গভর্নরও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি গির্জার ভেতরে আটকে পড়া মানুষদের সাহস ও ধৈর্যের প্রশংসা করেছেন।
হামলার পর পুরো মিশিগান অঙ্গরাজ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিহত ও আহতদের পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় খ্রিষ্টান সম্প্রদায় গির্জার সামনে সমবেদনা জ্ঞাপন ও প্রার্থনা সভা আয়োজন করেছে।
একজন পাদ্রি বলেছেন, "আমাদের বিশ্বাসের স্থানগুলো এখন নিরাপদ নয়, এটা সত্যিই দুঃখজনক। তবে আমরা ভয় পাব না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।"
মিশিগানের এই গির্জা হামলা আবারও প্রমাণ করল যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতা কীভাবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এক ব্যক্তির হঠাৎ উন্মত্ততা শত শত মানুষের জীবনে দুঃস্বপ্ন ডেকে আনল।
পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কেবল তদন্ত নয়—বরং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।