আফগানিস্তানের কৌশলগত সামরিক ঘাঁটি বাগরামকে ঘিরে ফের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ঘাঁটিটি ফেরত নিতে চান। তবে তালেবানরা তার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, কেন ট্রাম্প আবারও বাগরাম ফেরত চাইছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র আদৌ কি ঘাঁটিটি ফিরে পেতে সক্ষম হবে?
বাগরাম ঘাঁটির ইতিহাস
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাগরাম বিমান ঘাঁটি মূলত ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্মাণ করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর এটি তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রায় এক দশক ব্যবহারের পর সোভিয়েতরা সরে গেলে বাগরাম কখনো আফগান সরকারের, কখনো তালেবানদের দখলে যায়।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করলে ঘাঁটিটি আবার নতুনভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সেখানে হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, এমনকি কারাগারও গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৯ সালে প্রায় ১০ হাজার মানুষের আবাসন সক্ষমতা ছিল ঘাঁটিটিতে। তবে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান ছাড়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র এটি খালি করে দেয়। এরপর স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো লুটপাট চালায় এবং শেষ পর্যন্ত তালেবানের হাতে যায় ঘাঁটিটি।
কেন বাগরাম গুরুত্বপূর্ণ?
ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র বহু দামী অস্ত্র ও সরঞ্জাম ফেলে এসেছে, সেটিই ফেরত নেওয়ার মূল কারণ। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি শুধু তাই নয়। বাগরাম একটি কৌশলগত সামরিক ঘাঁটি, যা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের খুব কাছাকাছি।
আফগানিস্তান থেকে চীনের সীমান্ত মাত্র ৮০০ কিলোমিটার দূরে, আর শিনজিয়াং অঞ্চলে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা বাগরাম থেকে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড পিস স্টাডিজ–এর বিশ্লেষক হেকমাতুল্লাহ আজমির মতে, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র বাগরামকে আবারও সক্রিয় ঘাঁটি হিসেবে চায়।
চীনও বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা ইতিমধ্যে জানিয়েছে, আফগানিস্তানের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে ওই দেশের জনগণ, বাইরের কোনো শক্তি নয়। অর্থাৎ চীন সরাসরি চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র আবার ওই অঞ্চলে পা রাখুক।
যুক্তরাষ্ট্র কি ঘাঁটিটি ফেরত পাবে?
এখানেই মূল প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, তালেবানদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তালেবান আন্দোলনের মূল ভিত্তিই ছিল বিদেশি দখলদারিত্ব হটানো। তাই যদি তারা বাগরাম ফেরত দেয়, তাহলে নিজেদের ভাবমূর্তি ও বৈধতা হারাবে।
অন্যদিকে ২০২০ সালে দোহায় স্বাক্ষরিত চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করবে না। ফলে সরাসরি ঘাঁটি ফেরত নেওয়া সহজ হবে না। যদিও ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, বাগরাম ফেরত না দিলে খারাপ কিছু ঘটতে পারে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, বাগরাম ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কূটনৈতিক দরকষাকষির অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে তারা হয়তো অন্তত কিছু অস্ত্র, সরঞ্জাম বা তথ্য ফেরত নিতে চাইবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশটি আফগানিস্তানে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ফেলে এসেছে, যা এখন তালেবানের হাতে।
সব মিলিয়ে, বাগরাম ঘাঁটি শুধু একটি সামরিক ঘাঁটি নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি চীনবিরোধী কৌশলগত ঘাঁটি, আর তালেবানের জন্য এটি সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তাই ঘাঁটি ফিরিয়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ট্রাম্পের দাবি যদিও রাজনৈতিক ও কৌশলগত বার্তা বহন করে, বাস্তবে এটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।