গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর তীব্রতম হামলায় আবারও রক্তাক্ত হলো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড। গতকাল শনিবার দিনের বিভিন্ন সময়ে চালানো বিমান ও স্থল অভিযানে অন্তত ৫১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু গাজা সিটিতেই প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩ জন। ইসরায়েল এ শহরে হামলার মাত্রা দিন দিন আরও বৃদ্ধি করেছে। ফলে শহরটিকে কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হয়েছে।
শহরজুড়ে আতঙ্ক ও অবরুদ্ধ জীবন
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তর জানায়, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজা সিটির মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কোনোভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাকি অর্ধেক মানুষ এখনো শহরের ভেতরে আটকা রয়েছেন। তাদের ভেতরে রেখেই ইসরায়েলি সেনারা অবিরাম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক বাসিন্দা প্রাণ বাঁচাতে ধ্বংসস্তূপের পাশে বা খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন। শিশু ও নারীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ
এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “গাজা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মৃত্যু ও ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করছে। এ ধরনের পরিস্থিতি আমি আগে কখনো দেখিনি।” গুতেরেস আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা ইসরায়েলের চাপের মুখে নতি স্বীকার না করে মানবিক অবস্থান গ্রহণ করে।
যুদ্ধের ভয়াবহ মানবিক মূল্য
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া গাজার যুদ্ধ ইতোমধ্যেই নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে এনেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬৫ হাজার ১৪১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই নারী, শিশু ও নিরীহ বেসামরিক নাগরিক। তবে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ হাজার হাজার লাশ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।
আহতের সংখ্যাও ভয়াবহ। এখন পর্যন্ত গাজায় অন্তত ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯২৫ জন মানুষ আহত হয়েছেন। আহতদের অনেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছেন না, কারণ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে বা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত।
স্বাস্থ্যখাতের ওপর হামলা
গাজায় শুধু বসতবাড়ি ও বাজার নয়, হাসপাতালের মতো জরুরি অবকাঠামোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। চিকিৎসাকর্মীদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি আল শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্সের পরিচালক মোহাম্মেদ আবু সালমিয়ার ভাইয়ের বাড়িতে ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক হামলা চালায়। ওই হামলায় তার ভাই মাজেদ আবু সালমিয়া নিহত হন। এর আগে বিভিন্ন হাসপাতালে হামলার ফলে বহু চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা
দীর্ঘদিন ধরে চলা হামলার ফলে গোটা গাজা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, বাজার, কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও যোগাযোগব্যবস্থা। ফলে বেঁচে থাকা মানুষের জীবনও ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে পড়ে গেছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ ও আশ্রয়ের সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মহলের চাপ
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি তুললেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বহু নেতা গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধের আহ্বান জানালেও ইসরায়েলি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গাজার মানুষ প্রতিদিন নতুন করে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। একদিনে ৫১ জনের প্রাণহানি সেই ভয়াবহ বাস্তবতার আরেকটি নির্মম উদাহরণ। সূত্র: আল-জাজিরা