বাংলাদেশ বর্তমানে পরিবেশদূষণের মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন। শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের পরিবেশ দিন দিন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে। পরিবেশদূষণ শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে না, বরং মানুষের স্বাস্থ্য, কৃষি এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
মাটি, পানি, বায়ু, শব্দ ও আলো—সব ধরনের দূষণ একত্র হয়ে পরিবেশদূষণের সৃষ্টি করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে পরিবেশদূষণের কারণে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ দূষণ এখন মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম বড় হুমকি।
বায়ুদূষণ
২০২৩ সালের আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের তুলনায় বাংলাদেশের বাতাসে ১৫ গুণ বেশি ক্ষতিকর কণা (PM) পাওয়া গেছে। যানবাহনের ধোঁয়া, পুরোনো বাস, রাস্তায় যানজট, কলকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইটভাটা ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ বায়ুদূষণের প্রধান কারণ।
শুধু ঢাকাতেই চলাচল করা বাসের ৮০ শতাংশ এক যুগের বেশি পুরোনো, যেগুলো মারাত্মক কালো ধোঁয়া নির্গত করে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৮ হাজার ইটভাটা রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ অবৈধ। এসব ইটভাটা নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর গ্যাস ছড়াচ্ছে। দৈনিক প্রায় ৩০ হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, যার ১০ শতাংশ প্লাস্টিকজাত।
ফলে শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ, ক্যানসার ও অ্যালার্জিসহ নানা জটিল রোগ বাড়ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে।
পানিদূষণ
বাংলাদেশে পানিদূষণও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রায় ৫০ হাজার কলকারখানার বর্জ্য নদী ও খালে পড়ছে। রাসায়নিক পদার্থ, ভারী ধাতু, রঞ্জক ও তেল সরাসরি পানিতে মিশে নদী–নালা দূষিত করছে। কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারে বিষাক্ত উপাদান পানিতে মিশে রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
এ ছাড়া পয়োনিষ্কাশনের দুর্বলতা, শহরের অপরিচ্ছন্নতা, তেল–গ্যাস উত্তোলন, আর্সেনিক, নদীতে চলমান যানের ময়লা, বাজারের বর্জ্য ফেলা—সবই পানিদূষণের কারণ। এর ফলে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডসহ পানিবাহিত রোগের পাশাপাশি ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগও ছড়িয়ে পড়ছে। পানিদূষণ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে, জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে এবং খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি তৈরি করছে।
শব্দদূষণ
শব্দদূষণ এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় নগর–সমস্যা। যানবাহনের হর্ন, মোটরবাইকের শব্দ, যানজট, নির্মাণকাজ, শিল্পকারখানার পুরোনো যন্ত্রপাতি, রাজনৈতিক সমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চ স্বরের মাইক—সবই শব্দদূষণের উৎস।
দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত শব্দে থাকার ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও বিরক্তির মতো সমস্যায় মানুষ ভুগছে। শুধু মানুষই নয়, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনও এতে ব্যাহত হচ্ছে।
মাটিদূষণ
প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার, শিল্পবর্জ্য, কৃষিক্ষেতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং বন উজাড় মাটিদূষণের বড় কারণ। এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং দূষিত মাটিতে উৎপাদিত খাবার মানবদেহে মারাত্মক ক্ষতি করছে। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে।
আলোকদূষণ
আধুনিকতার নামে অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার আজ আরেকটি নতুন সমস্যা। অতিরিক্ত আলো চোখের ক্ষতি, ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক চাপ তৈরি করছে। আলোকদূষণে শুধু মানুষ নয়, প্রাণী ও পাখিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাতেও এর প্রভাব পড়ছে।
করণীয়
পরিবেশদূষণ মোকাবিলায় সরকার ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি।
কালো ধোঁয়া নির্গত যানবাহন বন্ধ করা, পুরোনো গাড়ি কমানো এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।
ইটভাটার ধোঁয়া ও কলকারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ প্রয়োজন।
নির্মাণসাইটে ধুলা নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন বৃদ্ধি এবং প্লাস্টিক–পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
শিল্পকারখানার বর্জ্য–পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলতে হবে, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে এবং কৃষিক্ষেত্রে জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে।
শব্দদূষণ রোধে হাইড্রোলিক হর্ন ও সাইলেন্সারবিহীন মোটরবাইক বন্ধ করতে হবে, আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন নিষিদ্ধ করতে হবে।
আলো ব্যবহারে সংযমী হতে হবে, এলইডি ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
সর্বোপরি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর আইনের বাস্তবায়ন ছাড়া পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়।
পরিবেশ আমাদের টিকে থাকার একমাত্র ভরসা। এটিকে ধ্বংস করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করা। তাই বায়ু, পানি, মাটি, শব্দ ও আলো—সব ধরনের দূষণ কমাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকারের পাশাপাশি জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই দূষণ কমিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে।