লিভারপুলের হয়ে নবম মৌসুম শুরু করতে যাচ্ছেন মোহাম্মদ সালাহ। ২০১৭ সালে আনফিল্ডে যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি ৪০২ ম্যাচে ২৪৫ গোল করেছেন। মিসরীয় ফরোয়ার্ড ক্লাবের হয়ে জিতেছেন সবকটি ঘরোয়া শিরোপা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। যদিও জাতীয় দলের হয়ে নেই কোনো বড় সাফল্য। তারপরও মিসরীয় রাজা তিনি। ১১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের ফুটবলপাগল দেশে কীভাবে সাধারণ একটি পরিবারের ছেলে জাতীয় প্রতীকে পরিণত হলেন, সেই গল্প উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
মিসরের রাজধানী কায়রো, যেখান থেকে উত্তরে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে নাগরিগ গ্রামে পৌঁছান বিসিবির প্রতিনিধি। সেখানে এক যুবকেন্দ্রের সবুজ গেট খুলতে খুলতে একজন বলেন, ‘যখনই আমি এখানে আসি, তার চলাফেরার ধরন আর বল কন্ট্রোল করার ভঙ্গি মনে পড়ে যায়। এটা ছিল অন্যরকম কিছু।’ মোহাম্মদ সালাহকে নিয়ে কথাগুলো বলেন তার প্রথম দিককার একজন কোচ গামরি আবদেল-হামিদ এল-সাদানি। এই নাগরিগ গ্রামেই শুরু হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ডদের একজনের গল্প। গ্রামের রাস্তায় ৭ বছর বয়সী সালাহ বন্ধুদের সঙ্গে খেলত, কখনো নিজেকে ভাবত ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোনালদো, কখনো ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান, আবার কখনো ইতালির ফ্রান্সেস্কো টট্টি।
‘সব বাচ্চারাই হতে চায় সালাহ’
কৃষিপ্রধান গ্রাম নাগরিগ। চারদিকে সবুজ খেতখামার, যেখানে চাষ হয় জুঁই ফুল আর তরমুজ। কাদামাটির রাস্তায় পাশাপাশি চলাচল করে মহিষ, গরু, গাধা, গাড়ি, মোটরসাইকেল আর ঘোড়ার গাড়ি। গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যুবকেন্দ্রটি সম্প্রতি চমৎকারভাবে উন্নত করা হয়েছে। সবুজ ঘাসে মোড়া খেলার মাঠ দেখে মনে হবে এটি যেন কোনো পেশাদার ক্লাবের প্রশিক্ষণ মাঠ।
নাগরিগ গ্রামের প্রতিটি কোণায় সালাহর ছাপ- শিশুরা দৌড়াচ্ছে লিভারপুল ও মিসরের জার্সি পরে, পেছনে সালাহর নাম ও জার্সি নম্বর লেখা। তার পুরোনো স্কুলের দেয়ালে রয়েছে সালাহর একটি দেয়ালচিত্র। গ্রামের মাঝেই রয়েছে সেই নরসুন্দর দোকান, যেখানে কিশোর সালাহ প্রশিক্ষণ শেষে চুল কাটাতে যেত। নরসুন্দর আহমেদ এল মাসরি বলেন, ‘তার কার্লি হেয়ারস্টাইল আর দাড়ি আমিই বানিয়ে দিয়েছিলাম। তার বন্ধুরা বলত- এখানে চুল কাটিও না, আমরা তো গ্রামের, শহরের নই। কিন্তু সালাহ সব সময় আমার কাছেই আসত। পরদিন তার বন্ধুরা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত- ‘তোর নাপিত কে?’ আর এখন এল মাসরি নিজেই সালাহর মতো করে নিজেকে সাজিয়েছেন।
বাসযাত্রায় এত দূর
গ্রাম থেকে কায়রো শহরে যায় সাত আসনের সুজুকি ভ্যান। এই বাসস্টপ থেকেই শিশু সালাহর অনুশীলনের দীর্ঘ যাত্রা। প্রতিদিন সকাল ১০টায় বাড়ি থেকে বের হতেন ছোট সেই শিশু এবং বাড়ি ফিরতেন পারতেন না মধ্যরাতের আগে। বাস ছুটত বাসিউন শহরের দিকে- যেটি ছিল সালাহর কায়রো যাত্রার প্রথম ধাপ। সেখান থেকে তিনি উঠতেন আরেকটি বাসে, যেতেন টান্টা। সেখানেও আবার বাস বদলিয়ে পৌঁছাতেন কায়রোর রামসেস বাসস্টেশন, যেখানে আরও একবার গাড়ি বদলাতে হতো, তারপরেই গন্তব্যে পৌঁছানো যেত। সন্ধ্যার অনুশীলন শেষে ফিরতে হতো একই দীর্ঘ পথে, একই ধাপে ধাপে গাড়ি পরিবর্তন করে।
সপ্তাহে কয়েকবার এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কিশোর সালাহর জন্য কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, তা শুধু কল্পনা করা যায়। যিনি সালাহকে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে সুযোগ দিয়েছিলেন, তিনি মনে করেন- এ ধরনের অভিজ্ঞতাই তাকে শীর্ষ পর্যায়ে টিকে থাকার মানসিক শক্তি দিয়েছে। হ্যানি রামজি বলেন, ‘মিসরে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে শুরু করাটা সত্যিই কঠিন।’ ১৯৯০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা মিসর দলের সদস্য রামজি ১১ বছর খেলেছেন বুন্দেসলিগায়। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে সালাহকে তার সিনিয়র আন্তর্জাতিক অভিষেক করান তিনি।
মিসরের ‘সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রদূত’
মোহাম্মদ সালাহ ১৪ বছর ধরে মিসর জাতীয় দলে খেলছেন। মিসরে তার গুরুত্ব এতটাই যে, তিনি চোট পেলে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও প্রায়ই হস্তক্ষেপ করেন। স্মৃতিচারণ করেন জাতীয় দলের চিকিৎসক ড. মোহাম্মদ আবৌদ, লিভারপুল রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ২০১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে সালাহ গুরুতর কাঁধের চোট পাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে। সেই সময় অনেকেই মনে করেছিলেন, কয়েক সপ্তাহ পর রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ থেকে তিনি ছিটকে যাবেন। আবৌদ বলেন, ‘মিসরের স্বাস্থ্যমন্ত্রী পর্যন্ত আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি তখন বলেছিলাম, আতঙ্কিত হবেন না, সব কিছু ঠিকঠাক চলছে।’ শেষ পর্যন্ত সালাহ সুস্থ হয়ে দলের তিনটি গ্রুপ ম্যাচের মধ্যে দুটিতে খেলেন, তবে উরুগুয়ে, রাশিয়া এবং সৌদি আরবের কাছে হেরে মিসরের বিদায় ঠেকাতে পারেননি। তবে সালাহর হাত ধরে দীর্ঘ ২৮ বছর পর বিশ্বকাপে ফেরাই মিসরের জন্য বিশ্বজয়ের সমান।
মনের দিক থেকেও তিনি রাজা
নাগরিগে ফিরে বিবিসির প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হলো রাশিদার, ৭০ বছর বয়সী এক নারী, যিনি একটি ছোট স্টল থেকে সবজি বিক্রি করেন। তিনি বললেন, কীভাবে সালাহ তার এবং গ্রামের শত শত মানুষের জীবন বদলে দিয়েছেন।
লিভারপুল তারকার নামে সেখানে রয়েছে ‘মোহাম্মদ সালাহ চ্যারিটি ফাউন্ডেশন’: এতিম, তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবা নারী, দরিদ্র ও অসুস্থ মানুষদের সহায়তা করে। রাশিদার মতো বিধবাদের পেনশনের সঙ্গে অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হয়। রাশিদার মতো মানুষদের সাহায্যের পাশাপাশি সালাহ স্থানীয়দের জন্য নতুন ডাকঘর, অ্যাম্বুলেন্স ইউনিট, একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে অর্থায়ন করেছেন এবং পয়োনিষ্কাশনকেন্দ্রের জন্য জমি দান করেছেন- এর বাইরে আরও নানা প্রকল্প রয়েছে।